শীত আসছে। এই সময়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা খানিকটা বেশি থাকে। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে রোগটিকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক দেবার্ঘ্য ধুয়া।
প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাক কথাটা শুনলেই আমরা ঘাবড়ে যাই। এটা কতটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
উত্তর: আজকের সময়ে হৃদরোগ একটি অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হার্ট অ্যাটাক বা ডাক্তারি পরিভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্র্যাকশন রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ। ভারতবর্ষে এটি এখন এক নম্বর ঘাতক রোগ। ঠিকঠাক সময়ে সমস্যা ধরা না গেলে বা চিকিৎসা শুরু করা না গেলে অনেক ক্ষেত্রেই বেঁচে ফেরার আশা কম থাকে।
প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এটা বুঝবো কী করে?
উত্তর: হঠাৎ বুকে ব্যথা, অস্বস্তি, বুকের উপর কোনও ভারী কিছু চেপে থাকার অনুভূতি— এগুলি হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণ। এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হওয়া, ঘাম হওয়া এবং বুক ধড়ফড়ও করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবিটিস রোগীরা বুকের ব্যথা অনুভব করতে পারেন না। তখন এই লক্ষণগুলি দেখে চিকিৎসক হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না আন্দাজ করতে পারেন।
প্রশ্ন: বুকে কী ধরনের ব্যথা হলে বোঝা যাবে যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?
উত্তর: হার্ট অ্যাটাকের জন্য যে ধরনের ব্যথা হয় সেটি প্রকৃত অর্থে ঠিক ব্যথা নয়। মানে আঘাত লাগলে যে রকম ব্যথা হয় এটি মোটেও সে রকম নয়। এটা অনেকটা বুকে একটা অস্বস্তি (চেস্ট ডিসকমফর্ট)। কিংবা বুকটাকে কেউ চেপে ধরে আছে বা বুকের উপর ভারী কোনও ওজন চেপে আছে— এ ধরনের অনুভূতি। এই ব্যথা বুকের মাঝখানে কিংবা সারা বুক জুড়ে, কখনও গলা, চোয়াল বা ঘাড়ের দিকে, পিঠে, বাঁ হাতে এবং কদাচিৎ পেটের উপরের দিকেও হতে পারে বা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট, বমি বা ঘাম হতে পারে। এই ব্যথা বেশ কয়েক মিনিট এমনকী কয়েক ঘণ্টা অবধি থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, খুবই ক্ষণস্থায়ী (কয়েক সেকেন্ডের জন্য) ব্যথা কখনই হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা নয়। একই ভাবে জোরে নিঃশ্বাস নিতে গেলে যদি কোনও ব্যথা অনুভূত হয়, তবে সেই ব্যথাও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নয়।
প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে কি কোনও ভাবে পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব?
উত্তর: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও পূর্বাভাস থাকে না। হঠাৎ করেই এটি শুরু হয়। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার কিছু দিন আগে এক বা একাধিক বার একই ধরনের কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম বা হালকা ব্যথা রোগী অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে বিশ্রামরত অবস্থায় যদি বুকে ব্যথা শুরু হয় তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি। কারণ, অপেক্ষাকৃত হালকা ধরনের এবং কম সময়ের এই ব্যথা পরে গুরুতর হতে পারে। অনেক সচেতন রোগী এ রকম ব্যথা হওয়ায় সরবিট্রেট ট্যাবলেট জিভের তলায় নেওয়ার পরে এই ব্যথা উপশম হওয়ার কথা আমাদের কাছে বলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, সরবিট্রেট খেয়ে কমে যাওয়া ব্যথা প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই কার্ডিয়াক চেস্ট পেইন। তাই এই পূর্বাভাসটিকে কখনই অগ্রাহ্য করতে নেই। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাক হয় কেন বা কী ভাবে হয়?
উত্তর: হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্র্যাকশন হৃদপিণ্ডের নিজস্ব ধমনীগুলির (করোনারি আর্টারি) মধ্যে কোনও একটি ধমনীর আটকে যাওয়ার জন্য হয়। করোনারি আর্টারিতে ব্লকের জন্য রক্ত চলাচল ব্যাহত হলে সেই ধমনী হার্টের যে অংশের মাংশপেশীকে রক্ত সরবরাহ করে তা আটকে যায়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে সেই মাংসপেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হৃদপেশীর কোষগুলি নষ্ট বা মৃত হতে শুরু করে। এই ঘটনাটিকেই মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্র্যাকশন বলা হয়।
প্রশ্ন: করোনারি আর্টারিতে এই ব্লক কেন তৈরি হয়?
উত্তর: নানা কারণে করোনারি আর্টারির মধ্যে কোলেস্টেরল জমা হতে থাকে। এটিকে অথেরোস্ক্লেরোসিস বলা হয়। আস্তে আস্তে সেই জমা হওয়া কোলেস্টেরল পরিমাণ বাড়তে থাকে অর্থাৎ ব্লকটি বড় হতে থাকে। কোনও কারণে, এই কোলেস্টেরেল-এর ব্লক বা প্লাক ফেটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অনুচক্রিকারা এসে সেই অংশের রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেয় এবং ধমনীর মধ্যে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপান করা, ডায়াবিটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকা করোনারি আর্টারির মধ্যে কোলেস্টরেল জমার কয়েকটি প্রধান কারণ।
প্রশ্ন: ব্লকেজ হয়েছে কি না কী ভাবে ধরা যায়?
উত্তর: করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফির মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে ব্লকেজ হয়েছে কি না, ক’টি ধমনীতে ব্লকেজ, কত শতাংশ ব্লকেজ এগুলি নির্ণয় করা যায়। এ ছাড়া, কিছু নন ইনভেসিভ টেস্ট যেমন ট্রেড মিল টেস্ট-এর (টিএমটি) মাধ্যমে ব্লকেজের খানিকটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন: বুকে ব্যথা হলে প্রাথমিক ভাবে করণীয় কী?
উত্তর: বাড়িতে সরবিট্রেট ট্যাবলেট থাকলে একটি ৫মিলিগ্রামের ট্যাবলেট জিভের তলায় দেওয়া ভাল। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছের কোনও হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। কিছু প্রাথমিক পরীক্ষার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না নিণর্য় করা যায়। যেমন, ইসিজি, কার্ডিয়াক এনজাইম। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে ধরা পড়লে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত ধারণার কথা বলে রাখা খুবই জরুরি। হার্ট অ্যাটাকে বুকের ব্যথা হলে অনেকেই সেটিকে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করেন। ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই গ্যাসের ওষুধ খেয়ে বাড়িতে থেকে যান। ফলে অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এমনকী মৃত্যুও হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা এবং পরে তিনি কেমন জীবন কাটাবেন তা অনেকটাই নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে তার উপরে। অনেকেই গ্যাসের ব্যথা ভেবে ২-৩ দিন বাড়িতে থেকে যান। তাতে হার্টের ধমনী ২-৩ দিন বন্ধ থাকার ফলে হৃৎপেশীর অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। ওই হৃৎপেশী কাজ করতে না পারায় হার্ট সারা শরীরে ভালো ভাবে ব্লাড পাম্প করতে পারে না। একেই হার্ট ফেলিওর বলা হয়। হার্ট অ্যাটাকের রোগীর হার্ট ফেলিওর হয়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কমে যায়।
প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: হার্টের বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনীর ব্লকটিকে সরিয়ে রক্ত চলাচল পুনরায় চালু করাই হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য। এটি দু’টি উপায়ে করা যায়— ১) থ্রম্বোলাইসিস, ২) প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি। থ্রম্বোলাইসিসি-এ একটি ওষুধ প্রয়োগ করে করোনারি আর্টারির মধ্যে জমে থাকা ব্লাডের ক্লটটিকে গলিয়ে দেওয়া হয়। এই চিকিৎসার সাফল্যের হার ৬৬-৯৫ শতাংশ। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরে কত তাড়াতাড়ি এই ওষুধটি প্রয়োগ করা যায়, তার উপরে এর সাফল্য নির্ভর করে। প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির সফলতা থ্রম্বোলাইসিসের থেকে অনেক বেশি। এটিই এখন হার্ট অ্যাটাকের প্রধান চিকিৎসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন: প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি মানে কী?
উত্তর: প্রথমেই বলে রাখি, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের ধমনীর মধ্যে ব্লক ধরা পড়ে। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে যদি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে ব্লকটি সরিয়ে দেওয়া যায়, তবে তাকে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বলা হয়। যত তাড়াতাড়ি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ব্যবস্থা করা হবে, ততটাই হৃতপেশীকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো সম্ভব। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের পরে প্রতি মিনিটে কিছু না কিছু হৃৎপেশী নষ্ট হতে থাকে। তাই প্রতিটি মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: হার্টের অসুখ প্রতিকারের জন্য কী কী নিয়ম মেনে চলা উচিত?
উত্তর: ধূমপান বন্ধ করা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, ফল খাওয়া, সুগার, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। এগুলি মেনে চললে হার্টের অসুখ হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমানো যায়। যাদের বংশগত হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা রয়েছে, তাঁদের নিয়মিত হার্টের চেকআপ করানো খুব জরুরি। কারণ, বংশগত হার্টের অসুখও অন্যতম ভয়ের কারণ।
প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, হার্টের রোগীদের ডিমের কুসুম খাওয়া উচিত নয়, এটা কতটা ঠিক?
উত্তর: এ রকম কিছু ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ডিমের কুসুমে অনেক ভিটামিন এবং মিনারেল থাকে। কাজেই সেটা খাওয়া যেতেই পারে। তবে হার্টের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ডালডা বা বনস্পতি ঘি। অনেক রেস্তোরাঁয় বা দোকানে একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। এই তেল যত বার গরম করা হয় তত ট্রান্সফ্যাট বাড়তে থাকে। তাই এই পোড়াতেলে রান্না করা খাবার বা ডালডার খাবার বর্জন করাই ভাল। একই ভাবে মিষ্টিজাতীয় খাবার ও রেড মিট এড়িয়ে যাওয়ায় ভাল। তেলেভাজা খেতে হলে ঘরে সর্ষের তেলে ভাজা খাবার খাওয়াই শরীরের পক্ষে ভাল।
প্রশ্ন: সামনে শীতকাল আসছে, কোনও সাবধানতা নিতে হবে?
উত্তর: শীতে হার্টের অসুখ তুলনামূলক ভাবে বাড়ে। শীতে রক্তচাপ খানিকটা বেড়ে যায়। বুকে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কাও শীতে বেশি। তাই নুন কম খান, ফল খান বেশি। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। ওজন বেশি থাকলে কমান। জীবনযাত্রার এই কয়েকটা পরিবর্তন করলেই রক্তচাপ খানিকটা কমবে, হার্ট সুস্থ থাকবে। সাম্প্রতিক ‘হাইপার টেনশন গাইডলাইন্স’ অনুযায়ী রক্তচাপের ঊর্ধসীমা ১৪০/৯০ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ১৩০/৮০ হয়েছে। যাঁদের রক্তচাপ এর বেশি তাঁরা জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে বা চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে নিজের হার্টকে সুস্থ রাখুন।