কথায় যে বলে না, ‘বয়স আসলে একটা সংখ্যা ছাড়া কিছু না’, সেটা কিন্তু খুব একটা ভুল না৷ কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের দেখলে বোঝাই যায় না বয়স কত! নিজের যত্ন নিলে, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করলে আপনার বয়স যতই বাড়ুক না কেন, তারুণ্যের দীপ্তি এতটুকুও ম্লান হবে না৷ আবার অনেকেই আছেন, যাঁদের ৩০ পেরোতেই মাথার অর্ধেকের বেশি চুল পেকে যায়, চোখের কোলে কালি পড়ে, বলিরেখা স্পষ্ট দেখা যায়৷ এক কালে ৬০ ছুঁই ছুঁই মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত আক্রান্ত হতেন, এখন আরও ২০ বছর আগেই হার্টের অসুখে কাবু হয়ে পড়ছেন অনেকে৷
আমাদের জীবনযাত্রা যত স্ট্রেসফুল হচ্ছে, তত তাড়াতাড়ি ভিতর থেকে বুড়িয়ে যাচ্ছি আমরা৷ সুবিধেটা হচ্ছে, শরীরের বয়স মাপার একটা পদ্ধতি আছে৷ আর সেটা মোটেই খুব একটা কঠিন নয়, ইচ্ছে করলে আপনিও নিজের শরীরের আসল বয়সটা মেপে ফেলতে পারেন! তার পর সেই অনুযায়ী নিজেকে সুস্থ করে তোলার ছকও কষা সম্ভব৷
মেপে দেখুন নিজের হৃদস্পন্দনের হার
হার্ট বা হৃদয় হচ্ছে আপনার শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ এবং হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আপনিও ভালো থাকবেন৷ একজন সাধারণ মানুষের হার্ট প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বার স্পন্দিত হয়৷ বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির অ্যাথলিটদের হৃদস্পন্দনের হার সাধারণত মিনিটে ৫০-এর কম হয়, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সেই মাত্রাটা স্পর্শ করা সম্ভব নয়৷ হার্টবিট ধীর গতির হলে বুঝতে হবে আপনার হৃদয়ের স্বাস্থ্য ভালো৷ আর দ্রুত গতির অর্থ হচ্ছে স্বাভাবিক কাজ করতে আপনার হৃদয়কে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে৷ আপনি নিজের হৃদস্পন্দনের হার মেপে দেখতেই পারেন সহজে৷ বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নিচে আপনার ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা রাখুন৷ ধমনীর স্পন্দনটা অনুভব করতে পারবেন৷ ১৫ সেকেন্ডের জন্য তা মেপে 4 দিয়ে গুণ করে নিন৷ হৃদস্পন্দনের হার ১০০-র বেশি হলে আপনার বয়সের সঙ্গে 1 যোগ করুন৷
আপনার শরীর ঠিক কতটা ফ্লেক্সিবল?
আপনার শরীর ঠিক কতটা ফ্লেক্সিবল, তা দেখে আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে৷ যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন ও শরীরে মেদের বাহুল্য নেই, তাঁদের শরীর বেশিদিন ফ্লেক্সিবল থাকে, ফলে বয়স বাড়লেও তার প্রভাব চট করে শরীরকে ভোগ করতে হয় না৷ কিন্তু যাঁরা এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে কাজ করেন, খাওয়াদাওয়া বা ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সেই অর্থে কোনও নিয়ম মেনে চলেন না, তাঁদের ডিহাইড্রেশনের সমস্যা হয়, ফলে বদলাতে থাকে কলাকোষের কেমিক্যাল স্ট্রাকচার, মাসল ফাইবার ও কোলাজেন ফাইবার হারাতে থাকে ক্রমশ, বাড়তে থাকে ক্যালশিয়াম ডিপোজ়িট৷ আর এ সবের মিলিত ফল হিসেবে ফ্লেক্সিবিলিটি ক্রমশ তলানিতে গিয়ে ঠেকে৷ খুব সহজ একটা পরীক্ষা করলেই জানতে পারবেন আপনার শরীর ঠিক কতটা ফ্লেক্সিবল৷ মাটিতে পা ছড়িয়ে পিঠ সোজা করে বসুন৷ হাত দুটো ছড়িয়ে দিন সামনের দিকে৷ আপনার আঙুল যে পর্যন্ত প্রসারিত হচ্ছে, ঠিক সেই জায়গার মেঝেতে একটা দাগ দিন৷ এবার দুটো হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পায়ের পাতাটা ছোঁয়ার চেষ্টা করুন৷ দেখুন আপনার হাতের আঙুলগুলি পায়ের পাতার কত কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে৷ পিঠ ঝুঁকিয়ে যতটা নিয়ে যেতে পারছেন, সেই জায়গার মেঝেতে একটা দাগ দিন৷ যদি দুটো পয়েন্টের মাঝে 5 ইঞ্চি ব্যবধান থাকে, তা হলে বয়সের সঙ্গে ১ যোগ করুন৷ যদি ব্যবধানটা ১০ ইঞ্চির বেশি হয়, তা হলে ১ বাদ দিন৷ ফারাকটা ৫-১০-এর মধ্যে থাকলে কিছু যোগ করতেও হবে না, বাদও দেবেন না৷
আপনার কোমর আর নিতম্বের অনুপাত কত?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়ার একটা সমস্যা সাধারণত দেখা যায়৷ কোমরের আশপাশে মেদবাহুল্য থাকলেই শরীরের আকার নষ্ট হতে আরম্ভ করে, আর ভুঁড়ি বাড়তে থাকলেই বাড়ে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, ওবেসিটির আশঙ্কা৷ স্ট্রোক এবং কিছু কিছু ক্যানসারের ক্ষেত্রেও মেদবাহুল্য খুব বড়ো একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ আপনার নাভির দুই ইঞ্চি উপর থেকে কোমরের মাপ নিন৷ নিতম্ব যেখানে সবচেয়ে চওড়া, সেখানকার মাপ নিন৷ দুটোর অনুপাত বের করুন৷ পুরুষের ক্ষেত্রে অনুপাত ১.০ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে তা .৮৫-এর চেয়ে বেশি হলে বুঝতে হবে আপনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ওজন বহন করছেন এবং সেক্ষেত্রে আসল বয়সের সঙ্গে ১ যোগ করতে হবে৷
আপনার শারীরিক শক্তির পরিমাণ কত?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক শক্তির পরিমাণও ক্রমশ কমতে থাকে৷ সাধারণত 30 বছর বয়সের পর থেকে শরীরে মাসলের পরিমাণ ক্রমশ কমতে আরম্ভ করে৷ শারীরিকভাবে আপনি যত কম অ্যাকটিভ থাকবেন, তত দ্রুত হারে কমবে মাসলের পরিমাণ৷ শক্তি কমার অর্থ হচ্ছে আপনি পড়ে গেলে বেশি চোট পাবেন, হাড় ভঙ্গুর হয়ে আসবে৷ নিজের শক্তি পরীক্ষার জন্য পুশ-আপ করে দেখুন৷ যদি এক নাগাড়ে ১০-এর বেশি পুশ আপ করতে পারেন (বুক মাটির 4 ইঞ্চির কাছাকাছি আসবে), তা হলে মূল বয়স থেকে কিছু বাদ দেবেন না, যোগও করবেন না৷ ২০-টি করতে পারলে ১ আর ৩০-এর বেশি পারলে ২ বাদ দেবেন৷ যাঁরা ১০-এর আগেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন, তাঁরা যোগ করুন ১৷
আপনার বিএমআই কত?
নিজের উচ্চতা মেপে নিন, তার পর জেনে নিন ওজন৷ উচ্চতার স্কোয়ার দিয়ে ভাগ করুন ওজনকে৷ ভাগফল ২৫-এর বেশি হলে প্রমাণিত হবে আপনি ওভারওয়েট৷ ৩০-এর বেশি মানে আপনি ওবেসিটিতে ভুগছেন৷ ১৮.৫-র কম হলে আপনি আন্ডারওয়েট, সেক্ষেত্রে বয়সের সঙ্গে যোগ হবে ১৷ ১৮.৫-২৫-এর মধ্যে হলে কম ভাগফল হলে আপনার বয়স থেকে ১ বাদ দিন৷ ২৮-এর বেশি হলে আসল বয়সের সঙ্গে যোগ করুন ২, ৩০-এর বেশি হলে যোগ করুন ৩৷
শরীরে ফ্যাট বা মেদের পরিমাণ কত, সেটা জানুন
কোনও স্পোর্টস ট্রেনারের কাছে বা প্রথম সারির জিমে গিয়ে বডি ফ্যাট পারসেন্টেজের পরিমাণটা জেনে নিন৷ শরীরে মেদবাহুল্য যত বেশি হবে, সামগ্রিক স্বাস্থ্য তত খারাপ বলে ধরে নিতে হবে৷ মহিলাদের শরীরে ৩৩-এর বেশি শতাংশ ফ্যাট থাকলে ১ বছর যোগ করুন বয়সের সঙ্গে, ১৫-র কম মেদ থাকলেও ১ বছর যোগ হবে৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে ১ যোগ হবে পরিমাণ ২৫-এর বেশি বা ৬-এর কম হলে৷
আপনি প্রতিদিন কতক্ষণ ঘুমোন?
শরীর যদি প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পায়, তা হলে তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে৷ ফলে বাড়বে হাইপারটেনশন, কিডনির সমস্যা, স্ট্রোক, ওবেসিটির আশঙ্কা৷ প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমোনো বাধ্যতামূলক৷ যাঁরা প্রতি রাতে ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমোন বা ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমোন, তাঁরা বয়সের সঙ্গে ১ যোগ করুন৷ যাঁরা ৫ ঘণ্টার কম ঘুমোন, তাঁরা যোগ করুন ২৷ ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমোতে পারলে .৫ বাদ দিন৷
দূরে থাকুন ধূমপান, মদ্যপান ও জাঙ্ক ফুড থেকে:
কারণ প্রতিটিই আসলে আপনার শরীরের ক্ষতিসাধন করে৷ মহিলাদের ক্ষেত্রে দৈনিক একটি এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে দু’টি হচ্ছে মদ্যপানের সর্বোচ্চ মাত্রা৷ আপনি যে পানীয়টি খাচ্ছেন, তার অ্যালকোহলের মাত্রা কত, সেটা মেপে তবে বোঝা যাবে কতটা খেলে আপনি সর্বাধিক মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছেন৷ যে কোনও ধূমপানও স্বাস্ছ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক৷ একই কথা খাটে জাঙ্ক ফুড বা অতিরিক্ত মাত্রায় প্রসেসড ফুডের ক্ষেত্রে৷ শুধু চিনি নয়, বাড়তি নুনও আপনার শরীরের পক্ষে একইরকম ক্ষতিকারক৷ তার চেয়ে রোজের খাদ্যতালিকায় রাখুন কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, বাদাম, সবুজ শাকসবজি, ফল, মাছ, চিকেন, ডিম, ডাল ইত্যাদি৷ যাঁরা ধূমপান করেননি কখনও, তাঁরা নিজেদের আসল বয়স থেকে ৩ বাদ দিন৷ ৫ বছরের বেশ সময় আগে ধূমপান ত্যাগ করলে বাদ দিন ২৷ যাঁরা মদ্যপান করেন না, তাঁরা বাদ দিন ১৷ দৈনিক লক্ষ্যমাত্রা মেনে চললে বাদ দিন .৫৷ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি মদ্যপান করলে যোগ করুন ২, ধূমপানের ক্ষেত্রে যোগ করুন ৩৷ মাঝে-মধ্যে এক-আধটা আইসক্রিম-রোল-বার্গার খেলে ঠিক আছে, কিন্তু সেটাই যেন দৈনিক রুটিনে পরিণত না হয়৷ যাঁরা সপ্তাহে একবারের বেশি নিয়মের বাইরে গিয়ে রাস্তার ভাজাভুজি খান, তাঁরা প্রকৃত বয়সের সঙ্গে যোগ করুন ১৷